এইমাত্র পাওয়া খবর :
Home » , » বন্দুক আর পর্নোগ্রাফি নিয়ে শ্রীরামের রোমিও-লীলা

বন্দুক আর পর্নোগ্রাফি নিয়ে শ্রীরামের রোমিও-লীলা

Written By Unknown on ২৬ নভেম্বর ২০১৩ | মঙ্গলবার, নভেম্বর ২৬, ২০১৩

search engine optimization
 
 
 
 
রাম আর সীতা তো ১৪ বছর একসঙ্গে বনে থেকেছেন, কিন্তু সে সময়ে তাঁদের কোনও সন্তান হয় নি | তারপর রাবণ সীতাকে হরণ করে নিয়ে গেলেন | এরপরই সীতা গর্ভবতী হন,যমজ পুত্রসন্তানের জন্ম দেন | …১৪ বছরেও যে স্বামী-স্ত্রীর সন্তান হয় না, সেখানে এই আকস্মিক সন্তানলাভ কেমন একটা বেমানান নয় কি?… তবে কি লব আর কুশ রাবণের সন্তান?… রামও মনে মনে জানতেন, লব আর কুশ তাঁর সন্তান নয় |

বড় লেখকের রামায়ণ-ইন্টারপ্রিটেশনের এই টুকরো অংশটা শুনলেন তো? আসুন, আমরা এবার সোজা একটা আদালতের গল্পে ঢুকে পড়ি | এটা অবশ্য রামরাজ্যের সেই দাম্পত্য আদালত নয়, যেখানে দাঁড়িয়ে রঘুপতিরাঘব রাজা রাম, তার গর্ভিনী স্ত্রী সীতাকে অরণ্যে নির্বাসনদন্ড দিয়েছিলেন | কিংবা এটা সেই রাজসভা-আদালতও নয়, যেখানে, দুই ছেলেকে নিয়ে ফিরে আসার পরে, সীতাকে ফের নিজের সতীত্ব প্রমাণ করার জন্যে চিতায় উঠতে দিতে বলেছিলেন নির্দয় পুরুষোত্তম রাম | এটা হল গিয়ে মডার্ন ভারতের সেই আদালত, যেখানে ’প্রভুসমাজ ধার্মিক রামলীলা কমিটি’ এবং আরও অনেকগুলো হিন্দু ধর্মীয় সংগঠন সঞ্জয় লীলা ভনশালির নতুন ছবি রিলিজ করার আগেই অপার ক্রোধ আর গোঁয়ার্তুমিতে সেই ছবির বিরুদ্ধে পিটিশন দাখিল করে বসে | রাগের কারণ,ভনশালির ছবির আপত্তিকর নাম | কোন আক্কেলে তিনি ছবির নাম রাখেন ’রামলীলা’, আর তাতে ঠেসে দেন যৌনতা আর হিংস্র কদাচরণ?

নেহাত দেশে গণতন্ত্র চলছে কিনা, তাই ’ব্যানড’ হতে হতে কোনওমতে বেঁচে গেল ছবিটা | ছবি রিলিজের মোটে ৪৮ ঘণ্টা আগে আদালতের সামনে প্রায় মুচলেকা দিয়ে পরিচালক জানালেন, এ ছবির সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই হিন্দু ভগবান রামের | ছবির নামের সঙ্গে ’রাসলীলা’ শব্দটা আছে বটে, তবে, তার সঙ্গেও হিন্দু ভগবান কৃষ্ণের
কোনও সম্পর্ক নেই | ছবির নাম আর আগের মত শুধু ’রামলীলা’ রাখাও হচ্ছে না | ছবির নতুন নাম :’গোলিয়ো কি রাসলীলা রাম-লীলা’ |

আদালতে যখন এই কথাগুলো উচ্চারণ করছেন সঞ্জয় লীলা ভনশালি, তখনও ছবি মুক্তি পেতে পাক্কা ৪৮ ঘণ্টা বাকি | সবাই ছবির গান আর বিজ্ঞাপন দেখেছে বটে, কিন্তু ১৫৩ মিনিটের গোটা ছবিটা দেখে ওঠার সুযোগ হয়নি কারুরই | ভাগ্যিস হয়নি | কারণ ছবিটা দেখতে বসলে তখন তো যে কেউ আঁতকে উঠে ধরে ফেলত, নিজের ছবি বাঁচানোর দায়ে কীভাবে আদালতে মিথ্যে কথা বলতে বাধ্য হয়েছেন ধর্ম নিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, বাকস্বাধীন দেশের অসহায় চিত্রপরিচালক | ছবির পরতে পরতে তিনি বুনে দিয়েছেন হিন্দু ভগবান রাম আর কৃষ্ণের জীবন-কথকতা, আর মুখে বলতে বাধ্য হচ্ছেন এ ছবির সঙ্গে ওঁদের নাকি কোনও সম্পর্কই নেই | এ নাকি নিছকই উইলিয়াম শেক্সপিয়রের লেখা সেই রোমিও জুলিয়েট-অনুসৃত এক প্রেমকাহিনি |

গল্পের মূল কাঠামোটা হয়তো রোমিও জুলিয়েট থেকেই নিয়েছেন পরিচালক, সন্দেহ নেই | কিন্তু তারপরে রাম আর কৃষ্ণ, এই দুই ভগবানের মোটিফে যেভাবে জারিত করেছেন গোটা আখ্যানটাকে, দেখলে চমকে উঠবেন | সংলাপে সংলাপে রামের জন্য পাগলিনী সীতার হৃদয়-ব্যথা থেকে শুরু করে দেওয়ালে-দেওয়ালে ধনুর্ধর রামের বিশাল নগ্নগাত্র ছবি আর সেটাকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে সামনে ছবির ’রাম’ রণবীর সিংও তেল চকচকে নগ্ন গায়ে তাঁর পুরো সেক্স অ্যাপিল নিয়ে হাজির | এর পাশাপাশি ছবির গল্পের মধ্যে ঢুকে পড়ছে’নবরাত্রি উৎসব’ আর গল্পের ক্লাইম্যাক্স গিয়ে পৌঁছচ্ছে সোজা রাবণবধের দশেরায় | এরপরেও কি মানা সম্ভব যে সেই পৌরাণিক রামের সঙ্গে এই নতুন রাম-রোমিওর কোনও সম্পর্কই নেই!

এর সঙ্গে ব্লেন্ড হয়েছে আরেক ভারতীয় ভগবান কৃষ্ণের ব্যঞ্জনা | ছবির গোড়াতেই রঙের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হোলিখেলার দৃশ্য | বৃন্দাবলে গোপিনীদের সঙ্গে এইভাবেই দোল খেলতেন না কৃষ্ণ? ছবির গল্পটাকে অব্দি গুজরাটের কচ্ছ-ঘেঁষা এক গ্রাম ’রণঝার’-এ নিয়ে গিয়ে ফেলেছেন পরিচালক, যাতে বারবার অবচেতনে মনে হতে থাকে, এভাবেই হয়ত ছুঁতে চাইছেন আর কয়েক কিলোমিটার দূরের আরেক মহাতীর্থস্থান দ্বারকাকে | ছবির আগাপাস্তলা জুড়ে ময়ূরের মোটিফ, এমনকি ছবির রাম যখন তার প্রেয়সী লীলার(দীপিকা পাড়ুকোন) ঘরে মাঝরাতে হানা দেয়, তখন লীলা তার স্বজনদের কাছে সেটাকেও ’ময়ূরের উপদ্রব’ বলে জানায় | দেহমিলনের বাসনা জাগলে, সেটাকে শব্দের অলঙ্কারে কীভাবে সাজানো হয় জানেন? রাম জানাচ্ছে : ময়ূরের কামনা জাগলে ওরা পেখম খোলে আর মানুষের কামনা জাগলে তারা পোশাক খোলে | এর পাশাপাশি গোটা ছবির অডিওট্র্যাক জুড়ে ময়ূরের কেকারব | এটাই সব নয়, আরও আছে | ছবির শেষদিকে রামকে যখন লীলার বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে আনা হচ্ছে, তখন নিমন্ত্রণ পত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয় অনবদ্য একগুচ্ছ ময়ূরপালক | লাল কাপড়ের আড়ালে শোয়ানো গুচ্ছ সেই ময়ূরপালক চকিতে যেন চোখে বিদ্যুৎ হেনে মনে করিয়ে দিয়ে যায়, কোন দেবতার অঙ্গসজ্জার অনিবার্য উপকরণ ছিল ময়ূরপালক | আদালতের সামনে মুখে যাই বলুন না কেন, রাম আর কৃষ্ণকে ঠিক এইভাবে পুনর্নির্মাণ করতে করতেই এই ছবির নায়ককে তৈরি করেছেন ভনশালি |

ছবির গল্প লেখার সময় দেশি-বিদেশি সিনেমা থেকে নির্বিচারে ঋণগ্রহণ করার সু-অভ্যেস রয়েছে ভনশালির | তাঁর প্রথম ছবি ’খামোশি দ্য মিউজিক্যাল’ (১৯৯৬)-এর কাহিনি বিন্যাসের সঙ্গে জার্মান ছবি ’বিয়ন্ড সাইলেন্স’-এর চমকপ্রদ সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন সুধী দর্শকেরা | ’হাম দিল দে চুকে সনম’ (১৯৯৯)-এর সঙ্গে যেমন বিস্ময়কর মিল পাওয়া যায় মৈত্রেয়ী দেবীর উপন্যাস ’ন হন্যতে’ আর মির্চা ইলিয়াদের উপন্যাস ‚’-র | ’দেবদাস’ (২০০২) ছবির ক্ষেত্রে অবশ্য এমন কিছু হবার কথাই ছিল না, কারণ এখানে তো ভনশালি একটি বহুল জনপ্রিয় টেক্সটকে বলে-কয়েই বিনির্মাণ করছেন | এরপর ’ব্ল্যাক’ (২০০৫) | এ ছবির গল্প ভনশালি চোখ বন্ধ করে তুলে নিলেন ’দ্য মিরাকল ওয়ার্কার’ থেকে | ’গুজারিশ’ (২০১০) ছবির জন্যে হাত পাততে হল ’হুজ লাইফ ইজ ইট ইনিওয়ে?’-র কাছে | ’গলিয়ো কি রাসলীলা রাম-লীলা’ ছবির গোড়াতে, নাম দেখানোর সময়েই গল্পের ক্রেডিট ভনশালি দিয়ে দিচ্ছেন শেক্সপিয়রকে | কিন্তু এই অবসরে যেটা চেপে গেছেন, সেটা হল, রোমিও জুলিয়েট-এর গপপো নতুন করে ফাঁদার সময়, দেশি-বিদেশি ঠিক কোন অ্যাডাপটেশানটার কাছে হাত পেতেছেন তিনি |

প্রবল শত্রু দুই পরিবারের দুই ছেলে-মেয়ের সঘন প্রেমকাহিনি আর তার ট্র্যাজিক সমাপ্তি, রোমিও-জুলিয়েটের এই চেনা মোটিফ হিন্দি-ইংরেজি সহ প্রায় সব ভাষার জনপ্রিয় ছবির এক অন্যতম উপাদান | রোমিও জুলিয়েটকে প্রায় আইকন হিসেবে ব্যবহার করে আজ পর্যন্ত ইংরেজি ছবি তৈরি হয়েছে নেহাত কম না | তার মধ্যে ভনশালির সবচেয়ে মনে ধরেছে ১৯৯৬ সালে তৈরি বাজ লুহারমান-এর তৈরি’রোমিও + জুলিয়েট’ ছবির বিন্যাস | এখানে বলে রাখি, এই অস্ট্রেলিয়ান চিত্রপরিচালক বাজ লুহরমানের সৃজন-সিনেমা জাতে-গোত্রে প্রায় বলিউডি ঘরানার কাছাকাছি | এব্যাপারে তিনি অনেকটা যেন ভনশালির জাতভাই | সেইরকম জাঁকজমকে ভরা সেট, সেইরকম নাচ গান, সেইরকম চোখ-ঝলসানো রঙের ব্যবহার | নিকোল কিডম্যানকে নিয়ে সেই ’ম্যুলা রুজ’ বা লিওনার্দো দি ক্যাপ্রিওকে নিয়ে ’দ্য গ্রেট গ্যাটসবি’ (যে ছবিতে অমিতাভ বচ্চন ছিলেন এক্সট্রা অভিনেতার ভূমিকায়) মনে পড়ছে কি? তাহলেই লুহরম্যানের ছবি তৈরির ধাতটা কীরকম, সেটা কতকটা বুঝতে পারবেন |

সেই লুহরম্যান যখন রোমিও-জুলিয়েটের প্রেম-আখ্যান থেকে ছবি করতে বসলেন, তখন গল্পটাকে আদ্যিকালের তরোয়াল-যুদ্ধের গল্প থেকে সরিয়ে নিয়ে এসে ফেললেন প্রায় সমসময়ের মাফিয়া ওয়ারের প্রেক্ষিতে | ছবি জুড়ে শুধু গুলি আর বন্দুকের সংঘর্ষ | সেই কর্কশ বাস্তবের পটভূমিতে তিনি এঁকে দেন’রোমিও’ লিওনার্দো দিক্যাপ্রিও আর ’জুলিয়েট’ ক্লেয়ার ডেনিসের প্রায় স্বপ্ন-সম্ভব প্রেমজীবন | রোমিও নিজেও তর্জন করে, বন্দুক চালায় | আর জুলিয়েটের পিঠে দুটি ডানা, যে ডানা দুটো তার শরীরের অংশ,নাকি তার পোশাকের ফ্যাশন-বাহুল্য? এই ছবির একটি জনপ্রিয় পোস্টার ওপরে দেওয়া হল, সেটা দেখলেই বুঝতে পারবেন, কেন গুলি-বন্দুকে সম্পৃক্ত ছবি ’রোমিও + জুলিয়েট’কে এত চট করে রাম-লীলার পূর্বসূরী বলে মনে হতে থাকে | মনে হবে না? রাম-লীলাতেও তো একই ভাবে বন্দুক-সংস্কৃতি আর মানুষের রক্ত মাখা সেলুলয়েড ঠেসে দেওয়া আছে | তার ওপর ছবিতে জোর করে বুনে দেওয়া হয়েছে একদম হালফিলের আরও চিহ্ন — টুইটার! তুবড়ে যাওয়া সম্পর্কের পরেও চোখের জল চোখেই ধরে রেখে রাম আর লীলা পাশাপাশি ছবি তোলে, প্রবল আয়রনিতে সেই ছবি টুইটারে দিয়ে নিজের সম্পর্ক জুড়ে যাবার প্রমাণ সাজাতে চায় রাম | আজকের দিনকে চিনে নেবার এর চেয়ে বেশি আর কোনও নিখুঁত দ্যোতক হতে পারে নাকি?

তবে একটা কথা | শুধু ভারতে নয়, এশিয়ার আরও দেশে-দেশে রামায়ণের বিচিত্র যে সমস্ত ভার্সন চালু রয়েছে, সেসব নিয়ে হয়তো ঠিকমত পড়াশুনো করে ওঠার সময় পাননি কোর্টের বিচারক কিংবা মাতাল গোঁয়ার রামভক্তরা | করলে ভনশালির ছবির ওপর এতটা রাগ করে আর থাকতে পারতেন নাকি? শ্রীলঙ্কায় রামায়ণের ছায়া নিয়েই লেখা হয়েছে কুমারদাস-এর ’জানকিরহরণ’ মহাকাব্য | সেখানে সীতা অসতী এক নারী, রাবণের সঙ্গ উপভোগে ব্যস্ত | ব্রহ্মদেশে রামকথার নাম ’রামবত্তু’, সেখানে রাম বোধিসত্ত্বের আরেক রূপ | ফিলিপিন্সে রামায়ণের প্রভাবে লেখা হয়েছে ’মহারাদিয়া লাওয়ান’, সেখানে লক্ষ্মণ এক বানরের নাম | মঙ্গোলিয়া, চীন, মালয়েশিয়া, হাঙ্গেরি, মেক্সিকো, সর্বত্র প্রাচীন উপকথায় পাওয়া যায় বিচিত্র সব রামকথার মিশ্রণ | এইসব কিছু পাঠ করার পরে সত্যি কি ভনশালির আর কোনও দোষ ধরা যায়? উদ্দাম যৌনতা আর পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হবার অপরাধে উত্তরপ্রদেশে লীলা ভনশালির রামকে মহামান্য আদালত নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিল বটে | কিন্তু এই সমস্ত দেশের সমস্ত রামায়ণের পাঠ-অধ্যয়ন করলে কি সেই আদালতের এবং এ দেশের বেবাক পাঁড় রামভক্তের মাথা ঘুরে যাবার কথা নয়?

উদ্দাম যৌনতা আর পর্নোগ্রাফিতে আসক্তির কথা শুনে ভুরু কুঁচকে গেল নাকি? একটুও বানিয়ে বললাম না কিন্তু | এ ছবির গোড়াতে খোদ রামের নিজের সংলাপেই এমন ইঙ্গিত রয়েছে যে, এলাকার সব যুবতীই রামের ’মর্দাংগি’র সম্যক পরিচয় পেয়ে গেছে | খালি গায়ে পেলভিক পোর্শন দুলিয়ে রতি-ভঙ্গিমার মুদ্রায় রামের নাচ দিয়ে সিনেমার শুরু | শুধু এটুকুই না | রাম ও তার দলের প্রিয় অবসর বিনোদন যে জমিয়ে পর্নো সিনেমা দেখা আর তাদের বাড়িতে যে নীল ছবির দেদার কালেকশন, সেটা তো গল্পে সোজাসুজিই আনডারলাইন করা আছে বারবার | সবাই মিলে জমিয়ে বসে ব্লু ফিল্ম দেখছে আর অডিও ট্র্যাকে শোনা যাচ্ছে রমণীর মিলনকালীন শীৎকার | কিংবা বাড়িতে লুকিয়ে রাখা গুলি-বন্দুকের খোঁজে পুলিশি হানা, সেই সময়ে পুলিশকে ভাগানো হচ্ছে ব্লু ফিল্মের সিডি ঘুষ দিয়ে | এরপর আরও উদাহরণ চান?

রামায়ণের পর্নোগ্রাফির অনুপ্রবেশ অবশ্য বাঙালি সংস্কৃতির মানুষ আমার কাছে অবশ্য একেবারেই নতুন কিছু নয় | কলেজ স্ট্রিটের সর্বাধিক নামী স্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়তে ঢুকে সেখানে ছাত্রদের মুখে জনপ্রিয় পর্নোগ্রাফিক ছড়া ’একদা রামচন্দ্র গিয়েছিল বনে’ শুনে চমকে গেছিলাম | ছড়ার স্তবকে স্তবকে রামায়ণের চরিত্রগুলোকে নিয়ে তুলকালাম পর্নো ফ্যান্টাসি | খোঁজ নিয়ে শুনি, এই ছড়া কে কবে বানিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছিল, কেউ জানে না, বছরের পর বছর ধরে সিনিয়রদের মুখ থেকে জুনিয়রদের মুখে মুখে এখন এর বিস্তার ঘটে চলেছে | ছড়ার পুরোটা শুনে সেদিন গা গরম হয়ে গেছিল যৌন অনুভূতিতে | আর আজ সেই কথা মনে পড়লে যে কী ভীষণ আয়রনির মত লাগে | তথাকথিত রামভক্তরা যে ধর্মের অন্তর্ভুক্ত,সেদিনের সেই স্কুলটার নামও ছিল কিনা ঠিক সেই ধর্মটারই নামে!

শেকসপিয়রের ’মন্টেগু’ আর ’ক্যাপুলেট’ ভনশালির ছবিতে এসে হয়ে গেছে ’রাজাদি’ আর ’সানেরা’ | এদের একদলের যুবক নেতা রাম আরেকদলের যৌবতী কন্যা লীলা | রামের উদ্ধত পেশি আর দৃপ্ত পৌরুষ | আর লীলার বুকের পোষাক সবসময়েই ঢলো-ঢলো, পিছলে অর্ধেক নেমে এসে আমাদের চোখ আর অনুভূতিকে আদর করে, সুড়সুড়ি দেয় | রাম তার লীলার শরীরের মাপ জানতে জানতে যখন তার বুকে এসে পৌঁছয়, লীলা বলে তার বুকের মাপ নাকি ১৩৬! এরপর দুজনের কি আশ্লেষে-ভরা চুম্বন | দুজনের শরীরেই ক্ষুধার্ত ছোবল দেয় তীব্র রিরংসা, মিলনার্তি | তবু এও এক আয়রনি যে ছবির শেষ দৃশ্য অব্দি দুজনে একবারও পূর্ণ যৌন-সম্ভোগে মেতে ওঠার অবসর পায় না, এমনকি লীলার সংলাপ থেকে জানা যায় রামের সঙ্গে বাইরে রাত কাটিয়ে আসার পরেও সে অনাঘ্রাতা অক্ষতযোনি | এই যে দুজনের মিলন-অসম্ভব এক ঘটনাক্রম, এবার এর সঙ্গে এ লেখার গোড়ায় দেওয়া সুনীলীয় ইন্টারপ্রিটেশনটা মিলিয়ে মিলিয়ে পড়ুন, দেখবেন আখ্যানে-আখ্যানে ভীষণ অস্বস্তিকর মিলটা কীভাবে আপনার অবচেতনে সেঁধিয়ে যাচ্ছে | এরপরেও রামভক্ত ভারতীয় হনুমানেরা জ্বলে পুড়ে না উঠে পারে নাকি?

‘হাম দিল দে চুকে সনম’, ’দেবদাস’ আর এই ’রাম-লীলা’কে উত্তরযুগ হয়ত একটা ট্রিলজি হিসেবে দেখবে | বেদনার ট্রিলজি | আর রঙের উদ্দাম উদ্ভাসের ট্রিলজি | একটু ভেবে দেখুন, তিনটে ছবিরই গল্পের শেষ ট্র্যাজিক সমাপ্তিতে আর তিনটে ছবিরই শরীর জুড়ে কাহিনির অতি বর্ণাঢ্য উপস্থাপনা | এমন যে, ছবি দেখার পরেও চোখে রঙের নেশা লেগে থাকে দীর্ঘ দীর্ঘক্ষণ | আর মগজের কোষে কোষে চুঁয়ে পড়তে থাকে ভালবাসা চেয়ে না পাবার তীব্র মারক বোধ |

সিনেমা বা মানবসভ্যতা আরও হাজার বছর বেঁচে থাকবে কিনা জানি না | তবে বেঁচে থাকলে বহু-সুদূরের এক ভবিষ্যতে এই ছবিও হয়তো হয়ে যাবে মূল রামায়ণের এক মান্য ভনশালি-ইনটারপ্রিটেশন | সেদিন আর মামলা হবে না কোনও আদালতে, বরং ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা রিসার্চ করবেন এর নির্মিতি আর দর্শন নিয়ে | কে বলতে পারে, এই রাম-জন্মভূমির সাংস্কৃতিক বিন্যাসে যে কিছুই বিচিত্র নয়!
রাম আর সীতা তো ১৪ বছর একসঙ্গে বনে থেকেছেন, কিন্তু সে সময়ে তাঁদের কোনও সন্তান হয় নি | তারপর রাবণ সীতাকে হরণ করে নিয়ে গেলেন | এরপরই সীতা গর্ভবতী হন,যমজ পুত্রসন্তানের জন্ম দেন | …১৪ বছরেও যে স্বামী-স্ত্রীর সন্তান হয় না, সেখানে এই আকস্মিক সন্তানলাভ কেমন একটা বেমানান নয় কি?… তবে কি লব আর কুশ রাবণের সন্তান?… রামও মনে মনে জানতেন, লব আর কুশ তাঁর সন্তান নয় |
অপর্ণা সেন : তোমার নামে তো ফতোয়া জারি হবে সুনীলদা?
- [সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কথাবার্তা সংগ্রহ, পৃষ্ঠা ৩৭০-৩৭১ : 'পরমা' পত্রিকার জন্য নেওয়া ইন্টারভিউ]
বড় লেখকের রামায়ণ-ইন্টারপ্রিটেশনের এই টুকরো অংশটা শুনলেন তো? আসুন, আমরা এবার সোজা একটা আদালতের গল্পে ঢুকে পড়ি | এটা অবশ্য রামরাজ্যের সেই দাম্পত্য আদালত নয়, যেখানে দাঁড়িয়ে রঘুপতিরাঘব রাজা রাম, তার গর্ভিনী স্ত্রী সীতাকে অরণ্যে নির্বাসনদন্ড দিয়েছিলেন | কিংবা এটা সেই রাজসভা-আদালতও নয়, যেখানে, দুই ছেলেকে নিয়ে ফিরে আসার পরে, সীতাকে ফের নিজের সতীত্ব প্রমাণ করার জন্যে চিতায় উঠতে দিতে বলেছিলেন নির্দয় পুরুষোত্তম রাম | এটা হল গিয়ে মডার্ন ভারতের সেই আদালত, যেখানে ’প্রভুসমাজ ধার্মিক রামলীলা কমিটি’ এবং আরও অনেকগুলো হিন্দু ধর্মীয় সংগঠন সঞ্জয় লীলা ভনশালির নতুন ছবি রিলিজ করার আগেই অপার ক্রোধ আর গোঁয়ার্তুমিতে সেই ছবির বিরুদ্ধে পিটিশন দাখিল করে বসে | রাগের কারণ,ভনশালির ছবির আপত্তিকর নাম | কোন আক্কেলে তিনি ছবির নাম রাখেন ’রামলীলা’, আর তাতে ঠেসে দেন যৌনতা আর হিংস্র কদাচরণ?
নেহাত দেশে গণতন্ত্র চলছে কিনা, তাই ’ব্যানড’ হতে হতে কোনওমতে বেঁচে গেল ছবিটা | ছবি রিলিজের মোটে ৪৮ ঘণ্টা আগে আদালতের সামনে প্রায় মুচলেকা দিয়ে পরিচালক জানালেন, এ ছবির সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই হিন্দু ভগবান রামের | ছবির নামের সঙ্গে ’রাসলীলা’ শব্দটা আছে বটে, তবে, তার সঙ্গেও হিন্দু ভগবান কৃষ্ণের
কোনও সম্পর্ক নেই | ছবির নাম আর আগের মত শুধু ’রামলীলা’ রাখাও হচ্ছে না | ছবির নতুন নাম :’গোলিয়ো কি রাসলীলা রাম-লীলা’ |
আদালতে যখন এই কথাগুলো উচ্চারণ করছেন সঞ্জয় লীলা ভনশালি, তখনও ছবি মুক্তি পেতে পাক্কা ৪৮ ঘণ্টা বাকি | সবাই ছবির গান আর বিজ্ঞাপন দেখেছে বটে, কিন্তু ১৫৩ মিনিটের গোটা ছবিটা দেখে ওঠার সুযোগ হয়নি কারুরই | ভাগ্যিস হয়নি | কারণ ছবিটা দেখতে বসলে তখন তো যে কেউ আঁতকে উঠে ধরে ফেলত, নিজের ছবি বাঁচানোর দায়ে কীভাবে আদালতে মিথ্যে কথা বলতে বাধ্য হয়েছেন ধর্ম নিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, বাকস্বাধীন দেশের অসহায় চিত্রপরিচালক | ছবির পরতে পরতে তিনি বুনে দিয়েছেন হিন্দু ভগবান রাম আর কৃষ্ণের জীবন-কথকতা, আর মুখে বলতে বাধ্য হচ্ছেন এ ছবির সঙ্গে ওঁদের নাকি কোনও সম্পর্কই নেই | এ নাকি নিছকই উইলিয়াম শেক্সপিয়রের লেখা সেই রোমিও জুলিয়েট-অনুসৃত এক প্রেমকাহিনি |
গল্পের মূল কাঠামোটা হয়তো রোমিও জুলিয়েট থেকেই নিয়েছেন পরিচালক, সন্দেহ নেই | কিন্তু তারপরে রাম আর কৃষ্ণ, এই দুই ভগবানের মোটিফে যেভাবে জারিত করেছেন গোটা আখ্যানটাকে, দেখলে চমকে উঠবেন | সংলাপে সংলাপে রামের জন্য পাগলিনী সীতার হৃদয়-ব্যথা থেকে শুরু করে দেওয়ালে-দেওয়ালে ধনুর্ধর রামের বিশাল নগ্নগাত্র ছবি আর সেটাকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে সামনে ছবির ’রাম’ রণবীর সিংও তেল চকচকে নগ্ন গায়ে তাঁর পুরো সেক্স অ্যাপিল নিয়ে হাজির | এর পাশাপাশি ছবির গল্পের মধ্যে ঢুকে পড়ছে’নবরাত্রি উৎসব’ আর গল্পের ক্লাইম্যাক্স গিয়ে পৌঁছচ্ছে সোজা রাবণবধের দশেরায় | এরপরেও কি মানা সম্ভব যে সেই পৌরাণিক রামের সঙ্গে এই নতুন রাম-রোমিওর কোনও সম্পর্কই নেই!
এর সঙ্গে ব্লেন্ড হয়েছে আরেক ভারতীয় ভগবান কৃষ্ণের ব্যঞ্জনা | ছবির গোড়াতেই রঙের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হোলিখেলার দৃশ্য | বৃন্দাবলে গোপিনীদের সঙ্গে এইভাবেই দোল খেলতেন না কৃষ্ণ? ছবির গল্পটাকে অব্দি গুজরাটের কচ্ছ-ঘেঁষা এক গ্রাম ’রণঝার’-এ নিয়ে গিয়ে ফেলেছেন পরিচালক, যাতে বারবার অবচেতনে মনে হতে থাকে, এভাবেই হয়ত ছুঁতে চাইছেন আর কয়েক কিলোমিটার দূরের আরেক মহাতীর্থস্থান দ্বারকাকে | ছবির আগাপাস্তলা জুড়ে ময়ূরের মোটিফ, এমনকি ছবির রাম যখন তার প্রেয়সী লীলার(দীপিকা পাড়ুকোন) ঘরে মাঝরাতে হানা দেয়, তখন লীলা তার স্বজনদের কাছে সেটাকেও ’ময়ূরের উপদ্রব’ বলে জানায় | দেহমিলনের বাসনা জাগলে, সেটাকে শব্দের অলঙ্কারে কীভাবে সাজানো হয় জানেন? রাম জানাচ্ছে : ময়ূরের কামনা জাগলে ওরা পেখম খোলে আর মানুষের কামনা জাগলে তারা পোশাক খোলে | এর পাশাপাশি গোটা ছবির অডিওট্র্যাক জুড়ে ময়ূরের কেকারব | এটাই সব নয়, আরও আছে | ছবির শেষদিকে রামকে যখন লীলার বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে আনা হচ্ছে, তখন নিমন্ত্রণ পত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয় অনবদ্য একগুচ্ছ ময়ূরপালক | লাল কাপড়ের আড়ালে শোয়ানো গুচ্ছ সেই ময়ূরপালক চকিতে যেন চোখে বিদ্যুৎ হেনে মনে করিয়ে দিয়ে যায়, কোন দেবতার অঙ্গসজ্জার অনিবার্য উপকরণ ছিল ময়ূরপালক | আদালতের সামনে মুখে যাই বলুন না কেন, রাম আর কৃষ্ণকে ঠিক এইভাবে পুনর্নির্মাণ করতে করতেই এই ছবির নায়ককে তৈরি করেছেন ভনশালি |
ছবির গল্প লেখার সময় দেশি-বিদেশি সিনেমা থেকে নির্বিচারে ঋণগ্রহণ করার সু-অভ্যেস রয়েছে ভনশালির | তাঁর প্রথম ছবি ’খামোশি দ্য মিউজিক্যাল’ (১৯৯৬)-এর কাহিনি বিন্যাসের সঙ্গে জার্মান ছবি ’বিয়ন্ড সাইলেন্স’-এর চমকপ্রদ সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন সুধী দর্শকেরা | ’হাম দিল দে চুকে সনম’ (১৯৯৯)-এর সঙ্গে যেমন বিস্ময়কর মিল পাওয়া যায় মৈত্রেয়ী দেবীর উপন্যাস ’ন হন্যতে’ আর মির্চা ইলিয়াদের উপন্যাস ‚’-র | ’দেবদাস’ (২০০২) ছবির ক্ষেত্রে অবশ্য এমন কিছু হবার কথাই ছিল না, কারণ এখানে তো ভনশালি একটি বহুল জনপ্রিয় টেক্সটকে বলে-কয়েই বিনির্মাণ করছেন | এরপর ’ব্ল্যাক’ (২০০৫) | এ ছবির গল্প ভনশালি চোখ বন্ধ করে তুলে নিলেন ’দ্য মিরাকল ওয়ার্কার’ থেকে | ’গুজারিশ’ (২০১০) ছবির জন্যে হাত পাততে হল ’হুজ লাইফ ইজ ইট ইনিওয়ে?’-র কাছে | ’গলিয়ো কি রাসলীলা রাম-লীলা’ ছবির গোড়াতে, নাম দেখানোর সময়েই গল্পের ক্রেডিট ভনশালি দিয়ে দিচ্ছেন শেক্সপিয়রকে | কিন্তু এই অবসরে যেটা চেপে গেছেন, সেটা হল, রোমিও জুলিয়েট-এর গপপো নতুন করে ফাঁদার সময়, দেশি-বিদেশি ঠিক কোন অ্যাডাপটেশানটার কাছে হাত পেতেছেন তিনি |
প্রবল শত্রু দুই পরিবারের দুই ছেলে-মেয়ের সঘন প্রেমকাহিনি আর তার ট্র্যাজিক সমাপ্তি, রোমিও-জুলিয়েটের এই চেনা মোটিফ হিন্দি-ইংরেজি সহ প্রায় সব ভাষার জনপ্রিয় ছবির এক অন্যতম উপাদান | রোমিও জুলিয়েটকে প্রায় আইকন হিসেবে ব্যবহার করে আজ পর্যন্ত ইংরেজি ছবি তৈরি হয়েছে নেহাত কম না | তার মধ্যে ভনশালির সবচেয়ে মনে ধরেছে ১৯৯৬ সালে তৈরি বাজ লুহারমান-এর তৈরি’রোমিও + জুলিয়েট’ ছবির বিন্যাস | এখানে বলে রাখি, এই অস্ট্রেলিয়ান চিত্রপরিচালক বাজ লুহরমানের সৃজন-সিনেমা জাতে-গোত্রে প্রায় বলিউডি ঘরানার কাছাকাছি | এব্যাপারে তিনি অনেকটা যেন ভনশালির জাতভাই | সেইরকম জাঁকজমকে ভরা সেট, সেইরকম নাচ গান, সেইরকম চোখ-ঝলসানো রঙের ব্যবহার | নিকোল কিডম্যানকে নিয়ে সেই ’ম্যুলা রুজ’ বা লিওনার্দো দি ক্যাপ্রিওকে নিয়ে ’দ্য গ্রেট গ্যাটসবি’ (যে ছবিতে অমিতাভ বচ্চন ছিলেন এক্সট্রা অভিনেতার ভূমিকায়) মনে পড়ছে কি? তাহলেই লুহরম্যানের ছবি তৈরির ধাতটা কীরকম, সেটা কতকটা বুঝতে পারবেন |
সেই লুহরম্যান যখন রোমিও-জুলিয়েটের প্রেম-আখ্যান থেকে ছবি করতে বসলেন, তখন গল্পটাকে আদ্যিকালের তরোয়াল-যুদ্ধের গল্প থেকে সরিয়ে নিয়ে এসে ফেললেন প্রায় সমসময়ের মাফিয়া ওয়ারের প্রেক্ষিতে | ছবি জুড়ে শুধু গুলি আর বন্দুকের সংঘর্ষ | সেই কর্কশ বাস্তবের পটভূমিতে তিনি এঁকে দেন’রোমিও’ লিওনার্দো দিক্যাপ্রিও আর ’জুলিয়েট’ ক্লেয়ার ডেনিসের প্রায় স্বপ্ন-সম্ভব প্রেমজীবন | রোমিও নিজেও তর্জন করে, বন্দুক চালায় | আর জুলিয়েটের পিঠে দুটি ডানা, যে ডানা দুটো তার শরীরের অংশ,নাকি তার পোশাকের ফ্যাশন-বাহুল্য? এই ছবির একটি জনপ্রিয় পোস্টার ওপরে দেওয়া হল, সেটা দেখলেই বুঝতে পারবেন, কেন গুলি-বন্দুকে সম্পৃক্ত ছবি ’রোমিও + জুলিয়েট’কে এত চট করে রাম-লীলার পূর্বসূরী বলে মনে হতে থাকে | মনে হবে না? রাম-লীলাতেও তো একই ভাবে বন্দুক-সংস্কৃতি আর মানুষের রক্ত মাখা সেলুলয়েড ঠেসে দেওয়া আছে | তার ওপর ছবিতে জোর করে বুনে দেওয়া হয়েছে একদম হালফিলের আরও চিহ্ন — টুইটার! তুবড়ে যাওয়া সম্পর্কের পরেও চোখের জল চোখেই ধরে রেখে রাম আর লীলা পাশাপাশি ছবি তোলে, প্রবল আয়রনিতে সেই ছবি টুইটারে দিয়ে নিজের সম্পর্ক জুড়ে যাবার প্রমাণ সাজাতে চায় রাম | আজকের দিনকে চিনে নেবার এর চেয়ে বেশি আর কোনও নিখুঁত দ্যোতক হতে পারে নাকি?
তবে একটা কথা | শুধু ভারতে নয়, এশিয়ার আরও দেশে-দেশে রামায়ণের বিচিত্র যে সমস্ত ভার্সন চালু রয়েছে, সেসব নিয়ে হয়তো ঠিকমত পড়াশুনো করে ওঠার সময় পাননি কোর্টের বিচারক কিংবা মাতাল গোঁয়ার রামভক্তরা | করলে ভনশালির ছবির ওপর এতটা রাগ করে আর থাকতে পারতেন নাকি? শ্রীলঙ্কায় রামায়ণের ছায়া নিয়েই লেখা হয়েছে কুমারদাস-এর ’জানকিরহরণ’ মহাকাব্য | সেখানে সীতা অসতী এক নারী, রাবণের সঙ্গ উপভোগে ব্যস্ত | ব্রহ্মদেশে রামকথার নাম ’রামবত্তু’, সেখানে রাম বোধিসত্ত্বের আরেক রূপ | ফিলিপিন্সে রামায়ণের প্রভাবে লেখা হয়েছে ’মহারাদিয়া লাওয়ান’, সেখানে লক্ষ্মণ এক বানরের নাম | মঙ্গোলিয়া, চীন, মালয়েশিয়া, হাঙ্গেরি, মেক্সিকো, সর্বত্র প্রাচীন উপকথায় পাওয়া যায় বিচিত্র সব রামকথার মিশ্রণ | এইসব কিছু পাঠ করার পরে সত্যি কি ভনশালির আর কোনও দোষ ধরা যায়? উদ্দাম যৌনতা আর পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হবার অপরাধে উত্তরপ্রদেশে লীলা ভনশালির রামকে মহামান্য আদালত নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিল বটে | কিন্তু এই সমস্ত দেশের সমস্ত রামায়ণের পাঠ-অধ্যয়ন করলে কি সেই আদালতের এবং এ দেশের বেবাক পাঁড় রামভক্তের মাথা ঘুরে যাবার কথা নয়?
উদ্দাম যৌনতা আর পর্নোগ্রাফিতে আসক্তির কথা শুনে ভুরু কুঁচকে গেল নাকি? একটুও বানিয়ে বললাম না কিন্তু | এ ছবির গোড়াতে খোদ রামের নিজের সংলাপেই এমন ইঙ্গিত রয়েছে যে, এলাকার সব যুবতীই রামের ’মর্দাংগি’র সম্যক পরিচয় পেয়ে গেছে | খালি গায়ে পেলভিক পোর্শন দুলিয়ে রতি-ভঙ্গিমার মুদ্রায় রামের নাচ দিয়ে সিনেমার শুরু | শুধু এটুকুই না | রাম ও তার দলের প্রিয় অবসর বিনোদন যে জমিয়ে পর্নো সিনেমা দেখা আর তাদের বাড়িতে যে নীল ছবির দেদার কালেকশন, সেটা তো গল্পে সোজাসুজিই আনডারলাইন করা আছে বারবার | সবাই মিলে জমিয়ে বসে ব্লু ফিল্ম দেখছে আর অডিও ট্র্যাকে শোনা যাচ্ছে রমণীর মিলনকালীন শীৎকার | কিংবা বাড়িতে লুকিয়ে রাখা গুলি-বন্দুকের খোঁজে পুলিশি হানা, সেই সময়ে পুলিশকে ভাগানো হচ্ছে ব্লু ফিল্মের সিডি ঘুষ দিয়ে | এরপর আরও উদাহরণ চান?
রামায়ণের পর্নোগ্রাফির অনুপ্রবেশ অবশ্য বাঙালি সংস্কৃতির মানুষ আমার কাছে অবশ্য একেবারেই নতুন কিছু নয় | কলেজ স্ট্রিটের সর্বাধিক নামী স্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়তে ঢুকে সেখানে ছাত্রদের মুখে জনপ্রিয় পর্নোগ্রাফিক ছড়া ’একদা রামচন্দ্র গিয়েছিল বনে’ শুনে চমকে গেছিলাম | ছড়ার স্তবকে স্তবকে রামায়ণের চরিত্রগুলোকে নিয়ে তুলকালাম পর্নো ফ্যান্টাসি | খোঁজ নিয়ে শুনি, এই ছড়া কে কবে বানিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছিল, কেউ জানে না, বছরের পর বছর ধরে সিনিয়রদের মুখ থেকে জুনিয়রদের মুখে মুখে এখন এর বিস্তার ঘটে চলেছে | ছড়ার পুরোটা শুনে সেদিন গা গরম হয়ে গেছিল যৌন অনুভূতিতে | আর আজ সেই কথা মনে পড়লে যে কী ভীষণ আয়রনির মত লাগে | তথাকথিত রামভক্তরা যে ধর্মের অন্তর্ভুক্ত,সেদিনের সেই স্কুলটার নামও ছিল কিনা ঠিক সেই ধর্মটারই নামে!
শেকসপিয়রের ’মন্টেগু’ আর ’ক্যাপুলেট’ ভনশালির ছবিতে এসে হয়ে গেছে ’রাজাদি’ আর ’সানেরা’ | এদের একদলের যুবক নেতা রাম আরেকদলের যৌবতী কন্যা লীলা | রামের উদ্ধত পেশি আর দৃপ্ত পৌরুষ | আর লীলার বুকের পোষাক সবসময়েই ঢলো-ঢলো, পিছলে অর্ধেক নেমে এসে আমাদের চোখ আর অনুভূতিকে আদর করে, সুড়সুড়ি দেয় | রাম তার লীলার শরীরের মাপ জানতে জানতে যখন তার বুকে এসে পৌঁছয়, লীলা বলে তার বুকের মাপ নাকি ১৩৬! এরপর দুজনের কি আশ্লেষে-ভরা চুম্বন | দুজনের শরীরেই ক্ষুধার্ত ছোবল দেয় তীব্র রিরংসা, মিলনার্তি | তবু এও এক আয়রনি যে ছবির শেষ দৃশ্য অব্দি দুজনে একবারও পূর্ণ যৌন-সম্ভোগে মেতে ওঠার অবসর পায় না, এমনকি লীলার সংলাপ থেকে জানা যায় রামের সঙ্গে বাইরে রাত কাটিয়ে আসার পরেও সে অনাঘ্রাতা অক্ষতযোনি | এই যে দুজনের মিলন-অসম্ভব এক ঘটনাক্রম, এবার এর সঙ্গে এ লেখার গোড়ায় দেওয়া সুনীলীয় ইন্টারপ্রিটেশনটা মিলিয়ে মিলিয়ে পড়ুন, দেখবেন আখ্যানে-আখ্যানে ভীষণ অস্বস্তিকর মিলটা কীভাবে আপনার অবচেতনে সেঁধিয়ে যাচ্ছে | এরপরেও রামভক্ত ভারতীয় হনুমানেরা জ্বলে পুড়ে না উঠে পারে নাকি?
‘হাম দিল দে চুকে সনম’, ’দেবদাস’ আর এই ’রাম-লীলা’কে উত্তরযুগ হয়ত একটা ট্রিলজি হিসেবে দেখবে | বেদনার ট্রিলজি | আর রঙের উদ্দাম উদ্ভাসের ট্রিলজি | একটু ভেবে দেখুন, তিনটে ছবিরই গল্পের শেষ ট্র্যাজিক সমাপ্তিতে আর তিনটে ছবিরই শরীর জুড়ে কাহিনির অতি বর্ণাঢ্য উপস্থাপনা | এমন যে, ছবি দেখার পরেও চোখে রঙের নেশা লেগে থাকে দীর্ঘ দীর্ঘক্ষণ | আর মগজের কোষে কোষে চুঁয়ে পড়তে থাকে ভালবাসা চেয়ে না পাবার তীব্র মারক বোধ |
সিনেমা বা মানবসভ্যতা আরও হাজার বছর বেঁচে থাকবে কিনা জানি না | তবে বেঁচে থাকলে বহু-সুদূরের এক ভবিষ্যতে এই ছবিও হয়তো হয়ে যাবে মূল রামায়ণের এক মান্য ভনশালি-ইনটারপ্রিটেশন | সেদিন আর মামলা হবে না কোনও আদালতে, বরং ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা রিসার্চ করবেন এর নির্মিতি আর দর্শন নিয়ে | কে বলতে পারে, এই রাম-জন্মভূমির সাংস্কৃতিক বিন্যাসে যে কিছুই বিচিত্র নয়!
- See more at: http://bd24live.com/8/%e0%a6%ac%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a6%e0%a7%81%e0%a6%95-%e0%a6%86%e0%a6%b0-%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%a8%e0%a7%8b%e0%a6%97%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%ab%e0%a6%bf-%e0%a6%a8%e0%a6%bf/#sthash.ThWv1FQL.dpuf
Share this post :
 
Auto Scroll Stop Scroll